ইমতিয়াজ বনানীতে অবস্থিত একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ছেন। বাড্ডা লিঙ্ক রোড এলাকায় কয়েক বন্ধু মিলে মেসে থাকতেন। মেস ছেড়ে দিয়ে এখন শাহজাদপুরে তার খালার বাসায় উঠেছেন। ইমতিয়াজ জানান, নিরাপত্তা নিয়ে তিনি নিজেও আতঙ্কিত ছিলেন। তবে বেশি আতঙ্কিত হয়েছেন তার মা-বাবা। গ্রামে অবস্থানকারী মা-বাবার জোরাজুরিতে মেস ছেড়ে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন বলে জানান ইমতিয়াজ। মেসের অন্য বন্ধুরাও যে যার মত চলে গেছে। কেউই নিরাপদ মনে করছে না। ইমতিয়াজ জানান, আত্মীয়ের বাসায় ওঠার পর প্রতিদিন বিকেলে বাসার বাইরে বের হতেন এবং সন্ধ্যার বেশ কিছু পর বাসায় ফিরতেন। এ সময় কয়েক বন্ধু মিলে রাস্তায়, চায়ের দোকানে বা সুবিধামতো খোলা জায়গায় বসে আড্ডা দিতেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরে বিকেলে আর বাসা থেকে বের হচ্ছেন না ইমতিয়াজ। কারণ ভয়। অনর্থক যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হয়রানির শিকার হতে হয় বা অন্য কোনো বিপদ আসে। খালার বাসা থেকে যেমন অপ্রয়োজনে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে তেমনি মা-বাবাও নিষেধ করেছেন। মা-বাবাসহ সবাই ইমতিয়াজকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বলে জানান ইমতিয়াজ।
খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া এলাকার মধ্যবয়সী সবুজ জানালেন সবচেয়ে উদ্বেগের কথা। তিনি বলেন, দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা এবং জঙ্গিবিরোধী অপারেশনের পর আমার ভেতরে ভয়ানক এক ধরনের আতঙ্ক চেপে বসেছে। আমার সবসময় মনে হচ্ছে রাস্তায় বের হলে আমি পুলিশের নজরে পড়তে পারি। পুলিশ আমাকে তল্লাশি করে জঙ্গি বলে ধরে নিয়ে যেতে পারে। আমাকে যদি জঙ্গি বলে ধরে নিয়ে যায় বা মেরে ফেলে আমার পক্ষে কেউ দাঁড়াবে না। আমার পক্ষে কারোর কিছু করার উপায় থাকবে না। কারণ তাতে তাদেরও বিরাট ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমি দেখেছি সম্প্রতি জঙ্গি হামলায় নিহতদের লাশ তাদের মা-বাবাও নিচ্ছেন না। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে মা-বাবা সন্তানের লাশ গ্রহণ করেন না তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? তারা এতটাই হয়রানির আতঙ্কে আতঙ্কিত যে, সন্তানের পরিচয়ও প্রকাশ করছেন না কেউ কেউ। পরিচয় প্রকাশ পেলেও সামনে আসছেন না ভয়ে।
সবুজ আরো আশঙ্কার কথা প্রকাশ করে বলেন, আমার সাথে যদি কারো কোনো শত্রুতা থাকে এবং সে যদি আমার কোনো ক্ষতি করার চিন্তায় আমার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জঙ্গি মর্মে অভিযোগ দেয় তাহলেই আমার জীবন শেষ করে দিতে পারে।
রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা রুমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করেছেন। তিনি তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, অবস্থা খুবই খারাপ। বাইরে বের হতে ভয় তো পাচ্ছিই। যেকোনো শপিং মলেও যেতে ভয় লাগছে। ইরাক ফ্রান্সের মতো বাংলাদেশেও এ ধরনের বোমা হামলা শুরু হয়ে যায় কি না ভেবে কোথাও যেতে ভয় পাচ্ছি।
রাজধানীর একজন বাসিন্দা জানান, আগে নামাজ শেষে মসজিদে বেশ কিছুটা সময় কাটাতাম দোয়া দরুদ পড়ে। এখন নামাজ শেষে সাথে সাথে বের হয়ে যাই। বেশি সময় মসজিদে অবস্থান করলে কেউ যদি কোনো ভুল ধারণা করে বসে। অনেক মসজিদে নামাজের পরপরই তালা লাগিয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
শুধু ইমতিয়াজ রুমি বা সবুজ নন, রাজধানীসহ সারা দেশের প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে এখন বিরাজ করছে নানামুখী ভয়ভীতি আর আতঙ্ক। তরুণ যুবক শ্রেণী বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন ভীতি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তাদের অভিভাবকরা। কল্যাণপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাবধারী ছাত্রীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন মেসে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ফলে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। কারণ বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলে বসবাসকারী ছাত্রীদের মধ্যে অসংখ্য ছাত্রী হিজাব পরিধান করে যারা কোনো ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গসঙ্গঠনের সাথে জড়িত নন। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছাত্রীসংস্থা ও জঙ্গি সন্দেহে হিজাবধারী ছাত্রীদের গ্রেফতারের ঘটনায় সব হিজাধারী শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশের প্রতিটি কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মেস করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বসবাস করছেন। তাদের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে। যেভাবে মেসে অভিযান চলছে এবং মেস বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে মেসে বসবাসকারী হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবনে।
শুধু রাজধানী বা দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চল নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা মাত্রায় নানামুখী উদ্বেগ বিরাজ করছে। বিভিন্ন গ্রামে নানাভাবে প্রচার করা হচ্ছে অপরিচিত কোনো যুবক মসজিদ বা এলাকায় ঘোরাঘুরি করলে থানায় খবর দেয়ার জন্য। একই সাথে জঙ্গিবিরোধী নানা ধরনের লিফলেট প্রচার নিয়েও চলছে নানা ধরনের গুজব।
পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী উপজেলার সোহাগদল গ্রামের শহিদুল ইসলাম জানান, তার এক ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে এবং মেসে থাকে। দেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ড এবং জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে ছেলেকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ছেলের মা-বাবা। একই গ্রামের শাহেদ আলী জানান, তার এক ছেলে ঢাকার তিতুমীর কলেজে পড়ে এবং মেসে থাকে। সে নিয়মিত নামাজ পড়ে। দাড়িও আছে। তবে সে কোনোরকম রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। কিন্তু দেশে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। ঢাকায় এমন কোনো নিকটাত্মীয়ও নেই যে, মেস ছেড়ে সেখানে উঠবে।
এ জাতীয় সমস্যা ছাড়াও আরো অনেক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা এবং ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মনে। অনেকে আতঙ্কে আছেন ভবিষ্যতে আরো এ ধরনের জঙ্গি হামলা হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। দীর্ঘ দিন ধরে দেশে রাজনৈতিক হানাহানির সময়ও মানুষের মনে এতটা নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করেনি। অনেক দিন ধরে রাজপথে রাজনৈতিক হানাহানি না থাকলেও চলমান ছিল প্রতিপক্ষ দমনপীড়নকার্যক্রম। হাজার হাজার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী গ্রেফতার, বিভিন্ন এলাকায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া, অনেক এলাকায় ভয়ে সব পুরুষ ঘরবাড়ি এমনকি এলাকাছাড়া হওয়া, মামলা, গুম, খুন, আর ক্রসফায়ারে একের পর এক তরতাজা তরুণ যুবকের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকার দৃশ্য জাতি দেখে আসছিল বিরামহীনভাবে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বিদেশী নাগরিক জিম্মি করে তাদের গণহারে হত্যা, জিম্মি উদ্ধার এবং জিম্মিকারীদের হত্যার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ছিল না। বিদেশে প্রায়ই জিম্মি এবং জিম্মিদের উদ্ধারে শ্বাসরুদ্ধকর বড় বড় অপারেশনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কিন্তু এ রকম একটি মর্মান্তিক ঘটনার অভিজ্ঞতার অংশীদার হলো বাংলাদেশ গত ১ জুলাই গুলশানে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা হত্যার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় একই স্টাইলে আরো কয়েকজন দেশী-বিদেশী নাগরিককে টার্গেট করে হত্যার ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক হানাহানির মধ্যেই বাংলদেশ সারা দেশে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা, বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানদের জঙ্গিকার্যক্রমের ঘটনা দেখেছে। এরপর জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গিসংঠনের নানা উপায়ে আত্মপ্রকাশ দেখেছে বাংলাদেশ। কখনো উড়ো চিঠি এবং কখনোবা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনার পর প্যাডসর্বস্ব নানা ধরনের জঙ্গিসংগঠনের দায় স্বীকারের ঘটনাও দেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সিরিয়া ও ইরাক ভিত্তিক জঙ্গিসংগঠন আইএস আত্মপ্রকাশের পর বাংলাদেশেও এর অস্তিত্ব থাকা বা না থাকা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিতর্ক চলতে থাকে। ব্লগারসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে একের পর এক এবং এর পেছনে বিভিন্ন জঙ্গিসংগঠনকে সন্দেহ করা হয়। বিভিন্ন সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার করা হয় অনেককে। তাদের অনেককে আইএসের সাথে সম্পর্কিত বলে প্রচার করা হয় ডিবি পুলিশেরই পক্ষ থেকে। এরপর তাবেলা হত্যার পর আইএসের কথিত দায়স্বীকারের পরই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করা হয় দেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব সম্পর্কে। আইএস আছে, আইএস নেই এ জাতীয় বিতর্ক, একের পর এক টার্গেট হত্যা ও আইএস কর্তৃক কথিত দায়স্বীকারের মধ্যেই গত ১ জুলাই ঘটে যায় গুলশানে হোলে আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হত্যাকাণ্ড এবং এরপর পবিত্র ঈদের দিন শোলাকিয়া ঈদের জামাতের কাছাকাছি এলাকায় হামলার ঘটনা। ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয় ৯ জঙ্গিকে।
রাজনৈতিক হানাহানি, দমনপীড়ন আর হত্যার ভীতি থেকে বাংলাদেশ প্রবেশ করে নতুন এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে। গুলশান হামলায় ১৭ জন বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ে কূটনীতিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়ীসহ সব মহলে। বিশেষ করে উদ্বেগ দেখা দেয় বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের ভবিষ্যৎ এবং জাপানসহ এ দেশে উদার বিদেশী বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গুলশান হামলায় অংশগ্রহণকারীদের পরিচয়ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে সারা দেশে। উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানদের এভাবে ধর্মের নামে বিভ্রান্ত হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় নতুন এক ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। নতুন এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে। সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়ায় দেশ। ভিন্নমাত্রার এক ধরনের ভয়ভীতি এবং অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। কেন এসব হচ্ছে, কারা রয়েছে এর পেছনে, কারা লাভবান হচ্ছে এতে, এর পরিণতি কী, দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে সর্বত্র। সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে কী হতে পারে এবং সমস্যা সমাধানে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা, রাজপথে গণহারে তল্লাশি, জঙ্গিবিরোধী অভিযানে যেসব গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে তাতে সব শ্রেণী- পেশার মানুষের মধ্যে নতুন মাত্রায় হয়রানি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি উত্তরণে এটি মোটেই সহায়ক নয় বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হয়রানি-আতঙ্কে আতঙ্কগ্রস্তরা। ব্যবসা বাণিজ্য্য শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে মন্দার আশঙ্কা করছেন অনেকে।