টকটকে লাল ট্রেনটা অন্তত দুবার ঘুরে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমাদের একটা আইসক্রিম খাওয়া শেষ। আরেকটি খাব? এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গরমও লাগছে। আইসক্রিমের লাইনে বিরাট লম্বা ভিড়। ট্রেনে চড়ার লাইনেও। কোনটা ধরব? টরন্টো শহরে লাইনে না দাঁড়িয়ে কোনো কিছু করার মতো অর্বাচীন আছে কে?
তৃতীয়বারও ট্রেনটা একদম যাত্রীভর্তি হয়ে আমাদের স্টপেজে এল, আর এখান থেকে কোনো যাত্রীই নিল না। টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে আছে এক জেন-জি। ‘আমি কী করব’-জাতীয় ভাব ধরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে।
আমার বন্ধু ফারজানা শাহরিনের জেদ চেপে গেল। ‘তুই এইখানে দাঁড়া, কাহিনি কী দেখে আসি,’ বলে আমি তার পিছু নেওয়ার আগেই জ্যাকেট, ব্যাগসহ ছুট দিলাম সামনে। ওখান থেকে ফোনে জানাল আসল কাহিনি। ওটা প্রথম স্টপেজ। সেখান থেকেই একদম ভরে পরের স্টপেজগুলোয় আসছে। এটাও কি সম্ভব! ওরা সিট ফাঁকা রেখে যাত্রী তুলবে না! মতিঝিল কিংবা ফার্মগেটের কন্ডাক্টর হলে এমনটা করতে পারত! আর আমাদের এত কষ্ট করে ট্রেনে ওঠার কী দরকার! চেরি তো আমরা দেখেই ফেলেছি। আর ট্রেনে কি জীবনে উঠিসনি। আমরা তো ট্রেনে যমুনা ব্রিজ পার করেছি, কতবার আমার মা-খালারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার করেছে…আর কানাডার এই খেলনা ট্রেন… ‘দৌড় দিয়ে এই স্টপে আয়। ট্রেন প্রায় চলে এসেছে,’ শাহরিনের শীতল কণ্ঠ শুনে আমি আর তর্ক করার সাহস পেলাম না।
গিয়ে শুনি ওখানেও এতক্ষণ ছিল এক জেন-জি। এই স্টপেজেই ট্রেন ভরে গেলে পরের স্টপেজে মানুষ উঠবে কীভাবে, এ নিয়ে তার হেলদোল নেই। যাক, বুদ্ধি করে প্রথম স্টপেজে এসে ট্রেন ধরব আর পরের স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে ‘কানাডিয়ান নাইসনেস’ দেখিয়ে বেশ একটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকাব, একটু মাথা নেড়ে ‘সরি’ বলার ভঙ্গি করব, এসব ভেবে ভালো লাগছে। এর মধ্যে জেন-জির শিফট শেষ হলো। এলেন বুমার আর মিলেনিয়ালের মাঝামাঝি এক নারী। ট্রেন এলে কয়েকটা সিট ভরলে তিনি রীতিমতো দরজা আগলে ‘নো, নো, নেক্সট ট্রেন’ করতে থাকলেন।
আমরা এসেছি টরন্টোর হাই পার্কে চেরি ব্লসম দেখার মৌসুমে। সকালে-বিকেলে জ্যাকেট লাগে, আবার দুপুরে কটকটে রোদ। কানাডার আবহাওয়ার মুড সুইংয়ের সময় এটা। অবশ্য তৈরি হয়েই এসেছি আমরা। জ্যাকেটের নিচে পছন্দের পোশাক, ব্যাকপ্যাকে পানি।
লাল টুকটুকে ছোট্ট একটা ট্রেন। বড়জোর ১৫-২০ জন বসতে পারে। লাল লাল বেঞ্চ। ট্রেন বলাও যায় না বোধ হয় একে। ট্র্যাক নেই কোনো। চারপাশ খোলা। টরন্টো শহরের মধ্যে হাই পার্কটা এত বিশাল, ট্রেনে চড়ে একবারে ঘুরে দেখার জন্যই রয়েছে এটা। এটুকু ট্রেনে ওঠার জন্য এত পাগল হওয়ার কী আছে! এ তো শিশুপার্কের ট্রেনের চেয়েও ছোট! আমরা আন্তনগর ভেজে খেয়ে ফেলার দেশের মানুষ। আমার বন্ধুর এই ট্রেন ব্যাকুলতার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
তবে সিটি বাজিয়ে সত্যিই যখন ট্রেনটা চলা শুরু করল, মুখে লাগল হাই পার্কের ঘাস-মাটি আর দূর থেকে আসা কোনো ফুলের মিষ্টি গন্ধ—আমি আমার বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হাসলাম যার অর্থ, ‘ইটস টোটালি ওয়ার্থ ইট।’ পাল্টা হাসিতে সে-ও বুঝিয়ে দিল, ‘জানতাম।’ স্কুলজীবনের বন্ধুদের তো আর সব মুখে বলে বোঝাতে হয় না!
দুই-তিন স্টপেজ পরেই আমরা নেমে গেলাম। ছবি তুলতে হবে তো! ও মা এ তো মাছের বাজার! ছবি তোলার জন্য রীতিমতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বড় ক্যামেরা, ট্রাইপড, বিরাট বিরাট লাইট নিয়ে ছবি তুলতে এসেছে মানুষ। বড় গাছগুলোর সামনে বেজায় ভিড়। আমরা ধারেকাছেই যেতে পারছি না। এরপর ঠিক করলাম আমাদের তো গাছ দরকার নেই। লাগবে চেরি ফুলের বড়সড় কয়েকটা ছড়া। একটু ফাঁকা দেখে ছোট একটা গাছ খুঁজে বের করে জ্যাকেট-ব্যাগ মাটিতে রেখে ছবি তোলা শুরু করলাম। পরে দেখি অনেকেই এই বাঙালি বুদ্ধি খাটানো শুরু করল। ছোট গাছের সামনেও ভিড় জমতে থাকল। আমরা ফোন চেক করলাম। অন্তত পাঁচটা ছবি হয়েছে না পোস্ট করার মতো! আবার চোখাচোখিতে যোগাযোগ, ‘ডান! চল এবার খেতে যাই।’
ওগো বিদেশিনী/ তোমার চেরি ফুল দাও/ আমার শিউলি নাও
চেরি ফুলের ছবি পোস্ট করেছি আর এই কথাটুকু কেউ মন্তব্যে লেখেনি, আজ পর্যন্ত তা ঘটেনি। এই গান আমার আগে শোনা হয়নি। ব্যাপারটা কী। একবার ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখলাম। লাল মেমসাহেব সিনেমার গান। প্রয়াত শিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া গান। অভিনয়ে অলিভিয়া ও ওয়াসিম।
পুরো গানটা শুনে বুঝলাম চতুর্থ লাইনটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ওগো বিদেশিনী
তোমার চেরি ফুল দাও
আমার শিউলি নাও
দু’জনে প্রেমে হই ঋণী
চেরি ফুল নিয়ে এত সুন্দর গান কি জাপানেও হয়েছে? আমি হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে পড়ি। একদল আছে না, যাদের বিদেশের সবকিছুই ভালো লাগে। আরেক দল যা-ই দেখে মুখ বাঁকা করে বলে এ তো আমাদের দেশেই আরও ভালো পাওয়া যায়!
শিউলির সঙ্গে চেরির অদলবদল? নাহ আমি মনে হয় রাজি হতাম না। এক, চেরি ফুলের স্থায়িত্ব খুব কম। মার্চ-এপ্রিল-মে বলা হলেও গোটা বছরে বড়জোর সপ্তাহ চারেক থাকে এই ফুল। আর তার চেয়েও বড় কথা, আমি আসলে আজ অবধি বুঝিইনি এর হালকা গোলাপি থেকে সাদার মাঝের নরম, খুব সূক্ষ্ম সৌন্দর্য। আমরা তো আগুনরঙা ফুলের দেশের মানুষ—কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জবা, রক্তকরবী, জারুল। আমাদের হালকা রঙের ফুলগুলোও তীব্র সুগন্ধে জানান দেয় তার উপস্থিতি—শিউলি, বকুল, হাসনাহেনা, কামিনী। অত নরম, পলকা, ‘এসেই বলে যাই যাই’ চেরিতে আমাদের পোষায় নাকি!

ও মা এ তো মাছের বাজার! ছবি তোলার জন্য রীতিমতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াইছবি: রুহিনা তাসকিন
তবে কানাডার সরকার কিন্তু এই গানের কপিরাইট নিয়ে অনুবাদ করে কাজে লাগাতে পারে। কানাডার চেরি ফুল সব জাপানের উপহার দেওয়া। বন্ধুত্ব-সৌহার্দ্যের প্রতীক হিসেবে। এর বদলে কানাডাও কিন্তু গান গেয়ে ধন্যবান জানাতে পারে।
কানাডার সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গাইছেন—ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও/ আমার মেপল নাও।
দারুণ না ব্যাপারটা!
শহরের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা
‘ছয় টাকা ভাড়া। যাবেন?’
‘ওঠেন।’
রিকশাওয়ালার এই কথা শুনলেই আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করত। তার মানে আমরা বড় খালার বাসায় যাচ্ছি। আর খালার বাসায় যাওয়ার পথেই পড়বে সেই রাস্তাটা। জানি, তা-ও জিজ্ঞেস করতাম, ‘আমরা কি ওই রাস্তাটা দিয়ে যাব?’ অনেক পরে জেনেছি, ওই রাস্তাটা হলো শহীদ মিনার থেকে নীলক্ষেত। লাল কৃষ্ণচূড়া কিংবা রাধাচূড়ায় ভরা। আমি আজও এই দুই ফুলের পার্থক্য মনে রাখতে পারি না।
শহীদ মিনারের দিকে এগোতে থাকলেই আমরা রিকশার হুড ফেলে দেব। আম্মা শক্ত করে ধরে রাখবেন চার-পাঁচ বছরের আমাকে। আমাদের মাথার ওপর ছাউনি হয়ে থাকবে অজস্র লাল কৃষ্ণচূড়া কিংবা রাধাচূড়া। আমার মাথার ওপর টুপটুপ করে ঝরবে কিছু পাপড়ি। আম্মা সাবধানে সরিয়ে দিয়ে আমার ক্লিপ দিয়ে চুল ঠিক করে দেবেন।
এরপর ওই রাস্তাই একরকম আমার ঘরবাড়ি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। কতবার হেঁটে, রিকশায় পার করেছি শৈশবের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তাটা। তখন আর তা সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো না। জ্যাম পড়লে বিরক্ত হতাম, ক্লাস ধরার তাড়া, সকালে ঘুম থেকে ওঠার বিরক্তি। আম্মাকেও কোনো দিন বলিনি, মা চলো তোমাকে হুডখোলা রিকশায় আমার ক্যাম্পাস দেখিয়ে আনি।
প্রতিবছর কানাডায় আমি আর শাহরিন চেরি ব্লসম দেখতে যাই। ওর ডাকনাম তিসি, আর আমার শামা। সময় অনুযায়ী চেরি ফুলের রং বুঝে একই রকম কাপড় পরে তিসি আর শামা চেরি ব্লসম দেখতে যাবেই। এ বছর চেরি ব্লসমের সময়টা আমি কানাডায় নেই। তিসি অনেকবার টেক্সট দিয়েছে, ‘তুই আসলি না, আমরা চেরি দেখতে যাব না?’
অন্য সময় হলে হয়তো আমার খারাপ লাগত। কিন্তু এবার ওর সঙ্গে আছে ছোট্ট আরিশা। স্ট্রলারে করে আরিশাকে নিয়ে ও ঠিকই যাবে হাই পার্ক। আরিশা ফুল দেখার চেয়ে রঙিন আইসক্রিমের দিকেই তাকিয়ে থাকবে। ওর কপালে এসে পড়বে চেরির পাতলা পাপড়ি। তিসি আলতো হাতে তুলে নিয়ে ক্লিপ দিয়ে ওর চুলটা ঠিক করে দেবে। ওরা হয়তো পার্ক থেকে ভিডিও কল দেবে আমাকে। আমি না থাকলেও আরিশার সঙ্গে লাল টুকটুকে ট্রেনে চড়ে মা-মেয়ে এবার চেরি ব্লসম দেখবে।
আরও পড়ুন